কাপ্তাই মর্জিনার মা’র হোটেল এর আয়েশা বেগম এর ঘুরে দাঁড়ানোর  গল্প


জয় বাংলা নিউজ প্রকাশের সময় : ১৮/১০/২০২৩, ১১:১২ PM / ৪২
কাপ্তাই মর্জিনার মা’র হোটেল এর আয়েশা বেগম এর ঘুরে দাঁড়ানোর  গল্প

ঝুলন দত্ত, কাপ্তাই ( রাঙামাটি) প্রতিনিধি।

রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার উপজেলা সদরে কাপ্তাই সড়কের কোল ঘেঁষে অবস্থিত একটা খাবার হোটেল । একনামে সকলে এটাকে মর্জিনার মা’র হোটেল নামে চিনে।
উপজেলা প্রশাসনে চাকরি করে কিংবা উপজেলা সদরে নানান কাজে আসা অনেকেই দুপুরে এই হোটেলে খাবার গ্রহন করে তৃপ্তি লাভ করে ।  ঘরোয়া পরিবেশে রুচিশীল সুস্বাদু রান্নার জন্য এই এলাকায় মর্জিনার মা’ র হোটেল এর বেশ নাম ডাক।

সেমিপাকা একটি ছোট্ট পরিসরের এই হোটেল কেন খদ্দের এর কাছে এতো  জনপ্রিয় এবং কে এই মর্জিনার মা, সব ক’টি উত্তর খোঁজার জন্য বুধবার (১৮ অক্টোবর)  দুপুরে এই প্রতিবেদক যায় মর্জিনার মা’র হোটেলে । তখন বেশ ভীড় ছিল দোকানে। মর্জিনার মা এবং আরোও একজন মহিলা সহকারী ব্যস্ত সময় পাড় করছেন হোটেলে আগত খদ্দেরদের আপ্যায়নে।
এই ফাঁকে কথা হয়, মর্জিনার মা’ র সাথে।

তিনি বলেন, আমার আসল নাম আয়েশা বেগম।
আমার বাবার বাড়ি রাঙ্গুনিয়া উপজেলার চন্দ্রঘোনা বনগ্রামে। আমার অল্প বয়সে বিয়ে হয় কুমিল্লা মো: ইউসুফ এর সাথে। তখন  তিনি চট্টগ্রাম বন্দরে চাকরি করতেন।  বিয়ের পর ১০ বছর  চট্টগ্রাম বন্দর এলাকায় স্বামী সহ থাকতাম। কিন্তু স্বামীর চাকরি চলে যাবার পর আমরা কাপ্তাই উপজেলার বড়ইছড়িতে একটি খাস জমিতে বাড়ি করে বসবাস করতে থাকি। এই ফাঁকে কাপ্তাই সড়কের পাশে কাপ্তাই থানার উল্টো পাশে আমার স্বামী একটি ফার্নিচারের দোকান দেয়। ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার যখন আসে তখন দোকানটি উচ্ছেদ করা হয়। তখন বেশ কষ্টে পড়ে যায়। উচ্ছেদ এর এক বছর পর ঐ স্থানে আমরা হোটেল এর ব্যবসা শুরু করি। যার নাম রাখি আমার বড় মেয়ে মর্জিনার নামে। স্বামী সহ আমি সেই হোটেল চালাইতাম । হঠাৎ দোকান দেবার ৩ বছরের মাথায় স্ট্রোক করে আমার স্বামী মারা যায়।  তখন আমি দুই মেয়ে নিয়ে চোখে অন্ধকার দেখি। চিন্তা করলাম, নিজেই স্বামীর ব্যবসা চালিয়ে যাব। শুরু হলো আমার জীবন সংগ্রাম। স্বামী মারা যাবার আগে এক মেয়েকে বিয়ে দিলেও অন্য মেয়েকে বিয়ে দিয় স্বামী মারা যাবার পর।

দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে আয়েশা  বেগম আরোও বলেন,   প্রতিদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে নিজে দোকানের জন্য বাজার করে, নিজেই ঘরোয়া পরিবেশে রান্না করি। এই ক্ষেত্রে আমাকে সহযোগিতা করার জন্য একজন মহিলা রেখেছি। বেলা ১২ টা হতে খদ্দের আসা শুরু করে। টানা প্রায় ৪ টা পর্যন্ত খদ্দের এর ভীড় লেগে থাকে। একদম বিশ্রাম পাইনা দুপুরে।  বিশেষ করে উপজেলা প্রশাসনে চাকুরিজীবী এবং প্রশাসনিক কাজে আসা লোকজন বেশী আসে আমার হোটেলে। ভর্তা, নানা রকম মাছ, বিভিন্ন পদের মাংস আমি নিজেই রান্না করে বিক্রি করি। তবে রাতে খদ্দের কম হয়। লোকজন যখন খেয়ে আমার রান্না প্রশংসা করেন, তখন সব কষ্ট ভুলে যায়। প্রতিদিন গড়ে আমি ৬ থেকে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করি। আমার সংসারে এখন অভাব নেই। আমি এখন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। তাই  অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী হিসাবে  ২০২১ সালে কাপ্তাই উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর হতে আমাকে জয়িতা নারী হিসাবে সম্মাননা দেন।

আয়েশা বেগম আরোও বলেন, উপজেলা সদরে যেই ঘরে আমি বসবাস করতাম, সেখান হতে আমাকে কিছু ষড়যন্ত্রকারী উচ্ছেদ করেছে। এখন আমি দোকানে রাত কাটাই।

বুধবার দুপুরে হোটেলে খেতে আসা কাপ্তাই রাইখালী ইউনিয়ন এর ইউসুফ তালুকদার এবং ওয়াগ্গা ইউনিয়ন এর বাবলু বিশ্বাস অমিত বলেন,  উপজেলা প্রশাসনের কাজে আসলেই প্রায়ই খাওয়া হয় এই হোটেলে।  অত্যন্ত ঘরোয়া পরিবেশে রান্না করা খাবার তিনি পরিবেশন করেন। তাঁরা উভয়ই জানান, এই মহিলা খুব পরিশ্রমী। নিজে রান্না করে আবার পরিবেশনও করেন।

উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা রিনি চাকমা জানান , মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর  কর্তৃক প্রতিবছর আন্তর্জাতিক  নারী নির্যাতন  প্রতিরোধ  পক্ষ (২৫ নভেম্বর হতে ১০ ডিসেম্বর) এবং  ৯ ডিসেম্বর  বেগম রোকেয়া দিবস উদযাপন  উপলক্ষে বিভিন্ন  প্রতিকূলতাকে জয় করে  সফল  হয়েছেন এমন ৫ ক্যাটাগরীর নারীদের তথা জয়ীতাদের চিহ্নিত  করে যথাযথ  সম্মান  ও স্বীকৃতি প্রদান করা হয়।এরই ধারাবাহিকতায়  ২০২১ সালে জীবন সংগ্রাম  করে প্রতিকূলতাকে জয় করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী  হওয়া কাপ্তাই উপজেলার  বড়ইছড়ি এলাকার  আয়েশা বেগমকে মহিলা বিষয়ক  অধিদপ্তর, কাপ্তাই  কর্তৃক  “অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী” হিসাবে সম্মান ও স্বীকৃতি দেয়া হয় । আমি মনে করি, আয়েশা বেগম আমাদের সমাজের অসহায় স্বামীহারা নারীদের জন্য একটি উদাহরণ। তাঁর জীবন সংগ্রাম দেখে অন্য নারীরাও এগিয়ে আসতে পারে।