চাকমা সমাজে নবান্ন উৎসব` (চাকমা উনর নুয়োভাত হানা) শীর্ষক দিনব্যাপী কর্মশালা অনুষ্টিত


জয় বাংলা নিউজ প্রকাশের সময় : ১৮/১১/২০২৩, ৭:৩৮ PM / ২১
চাকমা সমাজে নবান্ন উৎসব` (চাকমা উনর নুয়োভাত হানা)  শীর্ষক দিনব্যাপী কর্মশালা অনুষ্টিত

নিজস্ব সংবাদদাতা।

নবান্ন উৎসব যার যার সংস্কৃতিকে তুলে ধরে বলে  মন্তব্য করেছেন আলোচকরা। ‘চাকমা সমাজে নবান্ন উৎসব’ (চাকমা উনর নুয়োভাত হানা)  শীর্ষক দিনব্যাপী কর্মশালায় এই মন্তব্য করেন আলোচকরা। শনিবার(১৮ নভেম্বর) দিনব্যাপী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের আয়োজনে কেএসআই অডিটোরিয়ামে এই কর্মশালা অনুষ্টিত হয়।

বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের আহবায়ক সিং ইয়ং ম্রো”র সভাতিত্বে  প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের মূখ্যনির্বাহী কর্মকর্তা মাসুম বিল্লাহ, আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জেলা পরিষদের সদস্য সত্যহা পাঞ্জি, বান্দরবান সরকারী কলেজের সহকারী অধ্যাপক দিপন চাকমা, বান্দরবান সরকারী কলেজের প্রভাষক মেহেদি হাসান, সাংবাদিক মনিরুল ইসলাম মনু প্রমূখ।

মুল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বান্দরবান ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজের সিনিয়র শিক্ষক সন্তোষ চাকমা।  তিনি  চাকমা সমাজে নবান্ন উৎসব ( চাকমা উনর নুয়ো ভাত হানা)  প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন  কৃষিভিত্তিক সমাজে প্রায় সব দেশে, সব জনগোষ্ঠীর মধ্যে সব সংস্কৃতিতেই নবান্ন উৎসব পালন বা উদযাপনের প্রথা প্রচলিত রয়েছে।

অবশ্য উদ্‌যাপনের রীতি-প্রকৃতি ও পদ্ধতি প্রকরণের মধ্যে তারতম্য আছে, তবু সর্বক্ষেত্রেই মৌলিক ঐক্য আমাদের চোখে পড়ে – তা হলো কৃষি ফসল ঘরে তোলার আনন্দানুভূতি, উৎসব উদ্‌যাপন ও ভবিষ্যৎ জীবনে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রত্যাশায় মাঙ্গলিক আচার-অনুষ্ঠান পরিচালনা করা। চাক্‌মা কৃষিভিত্তিক সমাজেও এর ব্যতিক্রম হয় না। নবান্ন মানে নতুন অন্ন। চাক্‌মা সমাজে নবান্ন উৎসব হল জুম বা মাঠের নতুন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত করা চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব বা অনুষ্ঠান। গ্রাম বাংলায় ও পাহাড়ি পল্লিতে শব্দটি যে খুবই জনপ্রিয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। চাক্‌মা জনগোষ্ঠীর কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে সকল আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন সেগুলোর অন্যতম। চাকমাদের অতীত ও বর্তমান সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য  সম্পর্কে প্রবন্ধকার উল্লেখ করে বলেছেন  সুপ্রাচীনকাল থেকেই মঙ্গোলীয় গোষ্ঠীর বিভিন্ন শাখা বিভিন্ন সময়ে ব্রহ্মদেশ হয়ে পূর্বভারতে প্রবেশ করে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম অধ্যুষিত চাক্‌মা জাতিও মঙ্গোলীয় গোষ্ঠীভুক্ত। কালক্রমে ভারতের এই পূর্বাঞ্চলে আসাম ও পূর্ববাংলায় মঙ্গোলীয় ও অস্ট্রিক জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণ বিদগ্ধ পণ্ডিত ব্যক্তিদের দ্বারা স্বীকৃত। তা সত্ত্বেও এই অঞ্চলে বিভিন্ন মঙ্গোলীয় গোষ্ঠী নিজ নিজ সমাজ ও সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য রক্ষা করে চলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বৌদ্ধধর্মে বিশ্বাসী ও অনুসারী চাক্‌মা অধিবাসীদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল সরল
প্রাকৃতিক পরিবেশে সরল জীবনে তারা স্বভাবজাত হিসেবেই সহজ-সরল। কালক্রমে অন্যান্য সমসাময়িক জনগোষ্ঠীর তুলনায় নানা ক্ষেত্রে নানাভাবে প্রতারিত জীবনের অভিজ্ঞতায় কুটিলতা শিখেছে ও অভ্যস্ত হয়েছে। সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই জাতিগত বৈশিষ্ট্য, প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যে তারা স্বভাবতই সরল, অলস, প্রচুর খাদ্যবিলাসী, সৌখিন ও জাত্যাভিমানী অভাব জাতীয় চিন্তাধারায় তাদের জীবন গঠিত নয়। তাই বলে তারা উদ্দেশ্যবাদী সমতলবাসীদের মত ধনীও নয়। অভাব পীড়িত, জর্জরিত দারিদ্র্য জীবনের ছোঁয়ায় দুর্ভিক্ষ পীড়িত, মড়কও চাক্‌মাদের জীবনে দেখা যায়নি। বর্তমানে সরকারের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার মধ্যেও তারা স্বভাবজাত প্রকৃতিতে অমিতব্যয়ী, গরিব ও কোন কোন ক্ষেত্রে নিঃস্ব। সুবিধাবাদী রাজনৈতিক দলগত প্ৰতিযোগিতায় স্বল্প সংখ্যক বুদ্ধিজীবীদের কাছে হাতের পুতুল। নিজেরাই কূটনৈতিক দাবা খেলায় নিজেদের মধ্যে আন্তঃকলহ, দ্বন্দ্ব ও ক্ষমতার লড়াইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের উসকানিতে অন্ধ ও জর্জরিত। এত কিছুর মধ্যেও স্বল্প সংখ্যক জুমিয়া ও কৃষিজীবী সম্প্রদায় নিজেদের অজান্তে চাক্‌মাদের অতীত ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক নবান্নকে সংস্কৃতির কষ্টিপাথরে ধরে
রেখেছে বিভিন্নভাবে অনুষ্ঠান ও উৎসব আয়োজনের মাধ্যমে। চাক্‌মা সমাজে নবান্ন উৎসব বা চাক্‌মা উনর নুয়ো ভাত হানা : চাক্‌মাদের লোকাচার, নবান্নতে সাধারণত পূজো হয় দেবী অন্নপূর্ণার বা ফসলের দেবীর। কৃষিভিত্তিক বা জুম চাষ পদ্ধতিতে জুম কাটার পূর্বে ইষ্ট দেবতাকে স্মরণ করে বা পূজা করে অনুমতি নিয়ে শুরু করতে হয় যা
চাক্‌মা ভাষায় “জুম ফাং বা ফগদাং গরানা” বলা হয়। জুম কেটে পরিষ্কার করে উপযুক্ত সময়ে ধান, মারফা, তিল, তিসি, আদা, হলুদ, মরিচ, বরবটি, শিম, ঢেঁড়স, টক পাতা, বেগুন, মেইয়ে শাক (এক প্রকার মুলা শাক), উজোন শাকসহ নানা রকমের সবজির বীজ বপন করা হয়। জুমের মাঝখানে অথবা সুবিধাজনক স্থানে টং ঘর তুলে জুমিয়া পরিবার জুম ফসলের আগাছা পরিষ্কার করে ও বিভিন্ন পশু-পাখির হাত থেকে জুমকে রক্ষা করে।
জুমে ধানগাছসহ অন্যান্য ফসল যখন দিনে দিনে সবুজ রঙের আবেশে হিম শৈলীর হিমেল হাওয়ায় দোল খেতে খেতে বড় হতে থাকে তখন কৃষক দম্পতি সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রত্যাশার জাল বুনতে থাকে বাঁশি, দুদুক আর হেংগরং-এর সুরের মূর্ছনায় গভীর রাত পর্যন্ত, যা পাহাড়ের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দূরের দিগন্তে জুমের সাথে মিলিয়ে যায় ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে। অবশেষে ধান, মারফাসহ বিভিন্ন ফসলে যখন সোনালি রঙের আভা দেখা যেত
তখন জুমিয়া পরিবারে আনন্দের সীমা থাকে না। জুমের ধান পাকা শুরু করলে একটা শুভ দিন দেখে মাঠের ঈশান কোণ থেকে নতুন ধান এক মুঠো কেটে এনে কৃষকের ঘরের মূল খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয় পরবর্তী বছর নতুন ফসল ঘরে তোলার আগ পর্যন্ত, এই রীতি বহু প্রাচীন। নবান্ন উৎসবের আগে ধানের গোলা পরিষ্কার করে ধুয়ে-মুছে মাটি আর গোবরের মিশ্রণে প্রলেপ দেয়া হয়। মাড়াই ঘিরে আলপনা দেওয়া হয়। জুমের বা ক্ষেতের যে কোন প্রথম শস্যই ইষ্ট বা গৃহদেবতাকে নিবেদন করার রীতি ছিল চাক্‌মা সমাজে আর ধানতো প্রধান শস্য। হেমন্ত ঋতু আমাদের চতুর্থ ঋতু কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাস নিয়ে এ ঋতু। সকালের শিশির ভেজা ঘাস আর হালকা কুয়াশায় প্রকৃতিতে বেজে ওঠে শীতের আগমনী বার্তা। হেমন্ত ঋতুর পহেলা মাস কার্তিক আর কার্তিকের শুরু থেকেই ধান পাকতে শুরু করে। পাকা ধান কৃষক গোলায় তুলে রেখেদেন বারো মাস খাওয়ার ও দীর্ঘ দিন সংরক্ষণের জন্য। কৃষকের একার পক্ষে সম্ভব না হলে পাড়ার যুবক-যুবতিদের মালেয়ে (স্বেচ্ছাশ্রম) ডেকে পাকা ধান কাটা ও গোলায় তোলা উপলক্ষে কৃষক পরিবারে উৎসবের সৃষ্টি হয়। গ্রামের সবাই মিলে খুশি মনে খাওয়া হয় নতুন ধানের ভাত। আয়োজন হয় মুখরোচক খাবার, মাছ, মাংস, ঐতিহ্যবাহী পাজন। পরিবেশন করা হয় বিন্নি চালের কোমল মিষ্টি পানীয়, তৈরি করা হয় পিঠা-পায়েস। বিভিন্ন খাবারের পাশাপাশি সবাই মিলে গান-বাজনার মধ্য দিয়ে আনন্দানুষ্ঠান চলে গভীর রাত পর্যন্ত। নতুন ধান তোলার এবং খাওয়ার অনুষ্ঠানের এ আনন্দের নামই নবান্ন উৎসব।

প্রবন্ধের উপর আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন সাংবাদিক বুদ্ধজ্যোতি চাকমা, সুফল চাকমা, উসিথোয়াই মারমা,  মংসিং হাই মারমা, আকাশ মারমা, দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি অংচ মং মারমা, যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা পুলু প্রু মারমাসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আলোচকরা বলেন নবান্ন উৎসব যার যার নিজস্ব সংস্কৃতিকে তুলে ধরে প্রত্যেক জাতি সত্ত্বার লোকজন নবান্ন উৎসব পালন করে থাকেন বলে মত প্রকাশ করেন।