মহামানবের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি


জয় বাংলা নিউজ প্রকাশের সময় : ২০/০৮/২০২০, ৩:১০ PM /
মহামানবের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি

ইতিহাসের মহামানব, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৫তম শাহাদতবার্ষিকীতে- সেদিনের সেই কালরাতে জাতির পিতার পরিবারের সদস্যরাসহ যারা ঘাতকের নির্মম বুলেটে প্রাণ হারিয়েছিলেন তাদের সবাইকে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি।

শোকাবহ এ দিনটি জাতীয় শোক দিবস রূপে দেশ-বিদেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় ভাবগম্ভীর পরিবেশে প্রতি বছর পালিত হয়; কিন্তু এবার করোনা মহামারীর কারণে জনস্বাস্থ্য রক্ষায় সতর্কতার অংশ হিসেবে ‘জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ’ তথা ‘মুজিববর্ষ’, ‘গণহত্যা দিবস’, ‘স্বাধীনতা দিবস’, ‘বাংলা নববর্ষ’, ‘মুজিবনগর দিবস’, ‘শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস’, ‘৬ দফা দিবস’, ‘আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী’ এবং ‘শেখ কামাল ও বঙ্গমাতার জন্মদিন’ পালন উপলক্ষে গৃহীত রাষ্ট্রীয় ও দলীয় অনুষ্ঠানাদি সীমিতকরণ বা স্থগিত করা হয়েছে। আশা করি, সুষ্ঠু সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশাবলি সরকারের সংশ্লিষ্টরা অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করবেন এবং দেশের সর্বস্তরের জনসাধারণ দায়িত্বশীল আচরণের মধ্য দিয়ে এ ভয়াবহ দুর্যোগ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।

শোকের মাস আগস্টের ১৫ তারিখে দুনিয়ার নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের শ্রেষ্ঠবন্ধু জাতির পিতাকে আমরা হারিয়েছি- যার জন্ম না হলে এ দেশ স্বাধীন হতো না এবং আজও আমরা পাকিস্তানের দাসত্বের নিগড়ে আবদ্ধ থাকতাম। বছর ঘুরে এবারের শোক দিবস আমাদের জাতীয় জীবনে ফিরে এসেছে ভিন্নরূপে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ তথা ‘মুজিববর্ষ’ উপলক্ষে গৃহীত পদক্ষেপের ফলে জাতির পিতার জীবন ও কর্মের বহুবিধ দিক উন্মোচিত হওয়ায় তিনি আজ স্বমহিমায় প্রকাশিত। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর থেকে ’৯৬-এর আগে পর্যন্ত স্বৈরশাসকরা দেশে সর্বব্যাপী ভয়ের সংস্কৃতি বলবৎ করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ রুদ্ধ করেছিল। সেসব অন্যায় ইতিহাসের সত্যের স্রোতে ভেসে গেছে। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে ‘আওয়ামী লীগ’, ‘বঙ্গবন্ধু’ ও ‘বাংলাদেশ’ যে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত ও সমার্থক, আজ তা সবার কাছে সুস্পষ্ট। বঙ্গবন্ধু রচিত দুটি গ্রন্থ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ’কারাগারের রোজনামচা’ জাতীয় ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দলিল। অমূল্য এ গ্রন্থদ্বয় প্রকাশ করায় বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। ইতিহাসের অনেক অজানা কথা এ বই দুটো থেকে আমরা জানতে পেরেছি।

বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছি, এ পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয়নি। একদিন বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা বাঙালিদেরই হতে হবে।’ সেই লক্ষ্য সামনে নিয়ে ’৪৮-এর ৪ জানুয়ারি প্রথমে ছাত্রলীগ, পরে ’৪৯-এর ২৩ জুন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। ’৪৮ ও ’৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট, ’৫৬-এর শাসনতন্ত্র, ’৬২-এর শিক্ষা ও ’৬৪তে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করেন। ’৬৬-তে স্বায়ত্তশাসন-স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় বাঙালির মুক্তিসনদ ৬ দফা দাবির ভিত্তিতে দেশব্যাপী তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলেন; যা পরবর্তী সময়ে ১১ দফা দাবির ভিত্তিতে ’৬৯-এ দেশব্যাপী প্রবল গণআন্দোলন-গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করে সংগ্রামী ছাত্র-জনতা জাতির পিতাকে ফাঁসির মঞ্চ থেকে মুক্ত করে এবং কোটি মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত হন। এভাবেই মহান জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ভূমিধস বিজয় অর্জন করে বিশ্ববাসীর কাছে প্রমাণ করেন তিনিই বাঙালির একমাত্র বৈধ রাজনৈতিক নেতা। নির্বাচনের পর সামরিক শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে টালবাহানা শুরু করলে সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামী লীগদলীয় জনপ্রতিনিধিদের আসন্ন সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুতিপর্ব শুরু করেন। এর অংশ হিসেবে ’৭১-এর ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে ১০ লক্ষাধিক লোকের সামনে জনপ্রতিনিধিদের শপথ অনুষ্ঠান; ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ দলীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে পার্লামেন্টারি পার্টি গঠন ও ২১ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে শহীদ মিনারের পবিত্র বেদিতে দাঁড়িয়ে জনসাধারণকে ষড়যন্ত্র মোকাবেলা ও আসন্ন সংগ্রামের প্রস্তুতির নির্দেশনা প্রদান করেন।

৩ মার্চ আহূত জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে ১ মার্চ হোটেল পূর্বাণীতে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন প্রশ্নে যখন আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সভা চলছিল, তখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের আকস্মিক বেতার ভাষণে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন একতরফাভাবে স্থগিত ঘোষণা করলে বঙ্গবন্ধু সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা করেন। আসে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। যেদিন তিনি ভুবনবিখ্যাত ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণ আজ বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে আসীন। এরপর থেকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ পরিচালিত হতে থাকে এবং নিরস্ত্র বাঙালিকে সশস্ত্র জাতিতে পরিণত করে জাতীয় মুক্তির মোহনায় দাঁড় করান।

২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নীলনকশা অনুযায়ী পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরু করলে, ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করে বলেন, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।’ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে হাতিয়ার তুলে নিয়ে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর আমরা মহান বিজয় অর্জন করি এবং ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বিজয়ী বীরের বেশে বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। লন্ডন হয়ে দেশে ফেরার প্রাক্কালে এক সংবাদ সম্মেলনে বিদেশি সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্নে করেছিল, ‘আপনার দেশ তো ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে।’

উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার দেশের মানুষ যদি থাকে, মাটি যদি থাকে, তাহলে এ ধ্বংসস্তূপ থেকেই একদিন সুজলা, সুফলা, শস্যশ্যামলা সোনার বাংলা গড়ে উঠবে।’ দুটি লক্ষ্য নিয়ে তিনি রাজনীতি করেছেন। এক. বাংলাদেশের স্বাধীনতা। দুই. বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করা। তিনি গর্ব করে বলতেন, ‘আমার বাংলা হবে রূপসী বাংলা, আমার বাংলাদেশ হবে সোনার বাংলা, আমার বাংলাদেশ হবে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড।’ আজ তিনি টুঙ্গিপাড়ার কবরে শায়িত। আর কোনোদিন তিনি আসবেন না। সেই দরদি কণ্ঠে বাঙালি জাতিকে ডাকবেন না ‘ভায়েরা আমার’ বলে।

আমি বঙ্গবন্ধুর কাছে ছিলাম। সবসময় বলি আমি ভাগ্যবান মানুষ। যে নেতার জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না, সে রকম একজন মহান নেতার সান্নিধ্য, স্নেহ, আদর পাওয়া, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম পাওয়া। মনে পড়ে, ’৭০-এ বরিশাল-পটুয়াখালী-ভোলা অঞ্চলে নির্বাচনী সফরের কথা। ২৪ ফেব্রুয়ারি ছিল ভোলায় নির্বাচনী জনসভা। এদিন ভোলার ইতিহাসে সর্ববৃহৎ গণসমাবেশে- বঙ্গবন্ধু আমাকে আমি যা নই, তার পচয়ে অনেক বড় করে তুলে ধরে বক্তৃতা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু নেতাকর্মীদের এভাবে সম্বোধন করতেন। তিনি ছোটকে বড় করে তুলতেন।

যেসব জায়গায় সফর করতেন, সেখানকার নেতাকর্মীদের গুণবাচক বিশেষণ ঊর্ধ্বে তুলে ধরতেন। সহজেই পরকে আপন করেছেন। যারা বিরোধী ছিলেন, ভুবন-ভোলানো আচরণে তাদের কাছে টেনেছেন। যখন বলতেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না’, মানুষ তাই বিশ্বাস করত। ক্ষমতার জন্য, ক্ষমতায় থাকার জন্য, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য রাজনীতি করেননি। প্রিয় মাতৃভূমিকে শোষণ-বঞ্চনার হাত থেকে রক্ষা করে, বাঙালিরা যাতে বাংলাদেশের ভাগ্যনিয়ন্তা হতে পারে সেজন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতেই তিনি রাজনীতি করেছেন। সারাজীবন জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছেন। জীবনের ১২টি বছর কারান্তরালে কাটিয়েছেন। কোনোদিন মাথা নত করেননি।

মনে পড়ে ’৭১-এর রক্তঝরা মার্চের ১৭ তারিখের কথা। সেদিন ছিল বঙ্গবন্ধুর ৫২তম জন্মদিন। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা শেষে দুপুরে ধানমণ্ডির বাসভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে ঘরোয়া আলোচনাকালে একজন সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন, ‘৫২তম জন্মদিনে আপনার সবচেয়ে বড় ও পবিত্র কামনা কী?’ উত্তরে বঞ্চিত বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা স্বভাবসিদ্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘জনগণের সার্বিক মুক্তি।’ এরপর সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জ্ঞাপনকালে তিনি বেদনার্ত স্বরে বলেছিলেন, ‘আমি জন্মদিন পালন করি না- আমার জন্মদিনে মোমের বাতি জ্বালি না, কেকও কাটি না।

এদেশে মানুষের নিরাপত্তা নাই। আপনারা আমাদের জনগণের অবস্থা জানেন। অন্যের খেয়ালে যে কোনো মুহূর্তে তাদের মৃত্যু হতে পারে। আমি জনগণেরই একজন, আমার জন্মদিনই কী, আর মৃত্যুদিনই কী? আমার জনগণের জন্য আমার জীবন ও মৃত্যু।’ স্বাধীনতার পর বিশ্বখ্যাত সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘And when you see them digging a grave and you think of everything you will have to leave behind you, do you think of your country or, for instance, of your wife and children first?’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘I feel for my country and my people and then my family. I love my people more. I suffered for my people and you have seen how my people love me.’ সাগর-মহাসাগরের গভীরতা পরিমাপ করা যায়; কিন্তু দেশের মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা অপরিমেয়।

দেশ স্বাধীনের পর শূন্য হাতে যাত্রা শুরু করেন। গোলাঘরে চাল নেই, ব্যাংকে টাকা নেই, বৈদেশিক মুদ্রা নেই। রাস্তা-ঘাট-পুল-কালভার্ট, রেল, প্লেন, স্টিমার কিছুই নেই। যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংসপ্রাপ্ত। কিন্তু অতি তাড়াতাড়ি তিনি যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন করেন। ভৈরব ব্রিজ, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ যেগুলো ধ্বংস করেছিল সেগুলো পুনর্নির্মাণ করেন। বঙ্গবন্ধুর একক প্রচেষ্টায় ভারতীয় সেনাবাহিনী ’৭২-এর ১২ মার্চ বাংলাদেশ ত্যাগ করে। ’৭২-এর ৭-৮ এপ্রিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের বর্ণাঢ্য কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু পুনরায় সভাপতি ও জিল্লুর রহমান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

’৭২-এর ৪ নভেম্বর মাত্র ৭ মাসে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান প্রণয়ন করেন। জাতীয় সংসদের সফল নির্বাচন করে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেন। আজ যে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট মহাকাশে উৎক্ষেপিত হয়েছে, তারও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন ’৭৫-এ বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে। সেদিন আমি বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী ছিলাম। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়ার জন্য বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে দু’ভাগে। প্রথম ভাগে পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন এবং দ্বিতীয় ভাগে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন।

’৭৪-৭৫-এ বোরো মৌসুমে ২২ লাখ ৪৯ হাজার টন চাল উৎপাদিত হয়, যা ’৭৩-৭৪-এর চেয়ে ২৯ হাজার টন বেশি। বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ডিসেম্বরে ঘোষণা দেবেন দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। যে মুহূর্তে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে স্বাভাবিক করলেন, অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি দিলেন, ঠিক তখনই ঘাতকের নির্মম বুলেটে একাত্তরের পরাজিত শক্তি, বাংলার মীরজাফর বেঈমানরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। ওই সময় তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা প্রবাসে থাকায় ঘাতকদের হাত থেকে রেহাই পান।

বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে বাংলাদেশ বিশ্বের অধিকাংশ দেশের স্বীকৃতি লাভ করে। বিশ্বসভায় বঙ্গবন্ধু শ্রদ্ধার আসনে সমাসীন হন। সেসময় বাংলাদেশ যেসব আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে তার মধ্যে অন্যতম- ‘কমনওয়েলথ অব নেশনস্’, ‘জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন’, ‘ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা’ ও ‘জাতিসংঘ’। এ ৪টি আন্তর্জাতিক সংস্থার সম্মেলন ও অধিবেশনগুলোতে বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। প্রতিটি সম্মেলন ও অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। ’৭২-এর ৬ ফেব্রুয়ারি ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রথম বিদেশ সফর।

মুক্তিযুদ্ধের পরম মিত্র প্রতিবেশী ভারতের কলকাতা মহানগরীর ব্রিগেড ময়দানে ২০ লক্ষাধিক মানুষের গণমহাসমুদ্রে তিনি বক্তৃতা করেছিলেন। কলকাতার মানুষ সেদিন বাড়িঘর ছেড়ে জনসভায় ছুটে এসেছিল। সভাশেষে রাজভবনে যখন দ্বিপক্ষীয় আলোচনা হয়, তখন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার জন্মদিন ১৭ মার্চ। আপনি সেদিন বাংলাদেশ সফরে আসবেন। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার সফরের আগেই আমি চাই আপনার সেনাবাহিনী বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেবেন। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী সম্মতি জানিয়েছিলেন।

একই বছরের ১ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের আরেক মিত্রদেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেন তিনি। মহান মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের সার্বিক সমর্থন জুগিয়েছিল। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে ‘ভেটো’ ক্ষমতা প্রয়োগ করেছিল। সেদিন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সেই কোসিগিন বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন এবং ক্রেমলিনে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগর্নি, সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল লিওনিদ ইলিচ ব্রেজনেভ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকো বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন।

এটি ছিল এক বিরল ঘটনা। ’৭৩-এর ৩ আগস্ট কানাডার রাজধানী অটোয়াতে ৩২টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় কমনওয়েলথ সম্মেলন। সব নেতার মাঝে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেদিনের সেই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেছিলেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডো। বঙ্গবন্ধু সেদিন বক্তৃতায় বৃহৎ শক্তিবর্গের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘When elephants fight, it is the grass that suffers.’ তার এ বক্তৃতা উপস্থিত সবাইকে মুগ্ধ করেছিল। সেই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডোয়ার্ড হিথ্, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী এডোয়ার্ড হুইটলাম, তাঞ্জানিয়ার প্রেসিডেন্ট জুলিয়াস নায়ারে, জাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট কেনেথ কাউন্ডা, কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট জোমো কেনিয়াত্তা, সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান, শ্রীলঙ্কার শ্রীমাভো বন্দরনায়েকেসহ বিশ্বের বরেণ্য সব নেতা।

’৭৩-এর ৯ সেপ্টেম্বর আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে আলজেরিয়ার মঞ্চে দাঁড়িয়েই বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন, ‘বিশ্ব আজ দু’ভাগে বিভক্ত। শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’ ’৭৪-এর ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের পরদিন তিনি ইসলামিক সম্মেলনে যান। লাহোর বিমানবন্দরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট চৌধুরী ফজলে এলাহী ও প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। সেদিন দেখেছি- যে দেশ মুক্তিযুদ্ধে আমার দেশের নিরীহ-নিরপরাধ মানুষের ওপর গণহত্যা চালিয়ে ৩০ লক্ষাধিক মানুষ হত্যা করেছে- সেই দেশের মানুষ রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে স্লোগান তুলেছে ‘জিয়ে মুজিব জিয়ে মুজিব’, অর্থাৎ মুজিব জিন্দাবাদ মুজিব জিন্দাবাদ বলে। লাহোরে এ সম্মেলনের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। এমনকি যতক্ষণ তিনি লাহোরে না পৌঁছেছেন, ততক্ষণ সম্মেলন শুরু হয়নি। বঙ্গবন্ধুর জন্য সম্মেলন একদিন স্থগিত ছিল।

সালিমার গার্ডেনে যখন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের গণসংবর্ধনা দেয়া হয়, সেখানেও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। বঙ্গবন্ধু এমন আত্মমর্যাদাবান নেতা ছিলেন যে, সেদিন সৌদি বাদশাহের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে বলেছিলেন, ‘ইউর ম্যাজেস্টি, আপনি আমাকে স্বীকৃতি না দিয়েও আমার দেশের মানুষকে হজব্রত পালনের সুযোগ দিয়েছেন বলে আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।’ যুগোস্লাভিয়ায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সফরে গিয়েছিলাম। যুগোস্লাভিয়ার রাষ্ট্রনায়ক মার্শাল টিটো ও প্রধানমন্ত্রী জামান বিয়েদিস বিমানবন্দরে তাকে বীরোচিত অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন।

সেই দৃশ্য আজও আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। জাপান সফরে দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কাকুই তানাকা বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। সম্রাটের প্রাসাদে সম্রাট হিরোহিতো বঙ্গবন্ধুকে বিশেষ সম্মানের সঙ্গে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করেন। মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান। বিশেষভাবে মনে পড়ে, ’৭৪-এর ২৫ সেপ্টেম্বর যেদিন জাতির পিতা জাতিসংঘে মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক অনন্য ও মহত্তর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করা হয়েছিল ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি ইংরেজিতে বক্তৃতা করবেন।’

কিন্তু বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করতে চাই।’ যখন বক্তৃতা প্রদানের জন্য বঙ্গবন্ধুর নাম ঘোষিত হয়, তখন বিশ্ব নেতাদের মুহুর্মুহু করতালিতে চারদিক মুখরিত হয়ে ওঠে। মঞ্চে দাঁড়িয়ে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে চতুর্দিকে তাকিয়ে পরিষদে সমাগত বিশ্বনেতাদের বিনম্র সম্বোধন জ্ঞাপন করে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সর্বোচ্চ সংস্থা জাতিসংঘকে ‘মানব জাতির মহান পার্লামেন্ট’ উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু তার বক্তৃতা শুরু করেন। জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুই প্রথম রাষ্ট্রনায়ক যিনি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করেন। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘শান্তি ও ন্যায়ের জন্য পৃথিবীর সব মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা বিমূর্ত হয়ে উঠবে এমন এক নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে বাংলাদেশ আজ পূর্ণ অঙ্গীকারবদ্ধ। জাতিসংঘের সনদে যেসব মহান আদর্শ উৎকীর্ণ রয়েছে তারই জন্য আমাদের দেশের লাখ লাখ মানুষ চরম ত্যাগ স্বীকার করেছে।’ পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে বঙ্গবন্ধু ৪৫ মিনিট বক্তৃতা করেন।

বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশ্ব নেতাদের ছিল গভীর শ্রদ্ধা। আন্তর্জাতিক রাজনীতির হিমালয়সম উচ্চতায় আসীন ছিলেন তিনি। অধিবেশনে আগত বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা আমাদের কাছে এসে বলেছিলেন, ‘সত্যিই তোমরা গর্বিত জাতি। তোমরা এমন এক নেতার জন্ম দিয়েছ, যিনি শুধু বাংলাদেশের নেতা নন, এশিয়ার নেতা নন, তিনি সমগ্র বিশ্বের নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতা।’ আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে কিউবার রাষ্ট্রনায়ক ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি।’ বঙ্গবন্ধুর মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ বিশ্বে বিরল। যেখানেই গিয়েছেন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয় ’৭৫-এর ১৪ আগস্ট। প্রতিদিনের মতো সকালবেলা ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর, সেখান থেকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গণভবনে যাই। দিনের কাজ শেষে দুপুরবেলা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একই টেবিলে বসে একসঙ্গে খেয়েছি। বাসা থেকে বঙ্গবন্ধুর খাবার যেত। পরম শ্রদ্ধেয়া বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব- যিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর জীবনসঙ্গী। সুখে-দুঃখে, আপদে-বিপদে যিনি বঙ্গবন্ধুকে যত্ন করে রাখতেন। নিজ হাতে রান্না করে বঙ্গবন্ধুকে খাওয়াতেন। খাবার শেষে বঙ্গবন্ধু বিশ্রাম নিলেন। এরপর গণভবনে নিজ কক্ষে বসলেন। বঙ্গবন্ধু প্রায় প্রতিদিন বিকালে মন্ত্রিসভার সহকর্মীদের সঙ্গে দৈনন্দিন রাজনৈতিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করতেন। একসঙ্গে চা পান করতেন। এরপর রাত ৯টায় স্বীয় বাসভবনে ফিরতেন। বঙ্গবন্ধুকে পৌঁছে দিয়ে আমি বাসায় ফিরতাম। যেতামও একসঙ্গে, ফিরতামও একসঙ্গে। সেদিন বঙ্গবন্ধু আমাকে কাছে ডেকে বলেছিলেন, ‘কাল সকালে আমার বাসায় আসবি। আমার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবি।’ আমার আর প্রিয় নেতার সঙ্গে প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যাওয়া হয়নি।

তোফায়েল আহমেদ : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য, সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি

পুরাতন সংবাদ পড়ুন…

FriSatSunMonTueWedThu
      1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
30      
     12
10111213141516
24252627282930
31      
     12
       
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031    
       
  12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031  
       
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
2930     
       
    123
45678910
11121314151617
18192021222324
25262728293031
       
    123
45678910
18192021222324
25262728   
       
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031   
       
     12
3456789
17181920212223
24252627282930
31      
   1234
567891011
12131415161718
19202122232425
2627282930  
       
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031    
       
     12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
       
  12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031  
       
      1
2345678
16171819202122
23242526272829
3031     
    123
45678910
11121314151617
252627282930 
       
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031   
       
      1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
30      
   1234
567891011
262728293031 
       
   1234
567891011
19202122232425
262728    
       
15161718192021
22232425262728
293031    
       
    123
45678910
11121314151617
18192021222324
25262728293031
       
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031   
       
     12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31      
  12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031  
       
     12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31