বিশেষ প্রতিবেদন।
ক্রামাদি পাড়া, দেওয়াই হেডম্যান পাড়া, যামিনী পাড়া, ম্রোলং পাড়া,বসন্ত পাড়া, নোয়া পাড়াসহ চিম্বুক-নীলগিরি-থানচি সড়কের দুই পাশের পাহাড়ের পাদদেশে প্রায় ৯০টি ম্রো পাড়ায় দেখা দিয়েছে তীব্র বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট।
অতি সম্প্রতি বিভিন্ন পাড়ার পানির উৎস সমূহের খোঁজখবর নিতে সরেজমিনে গিয়ে দেখেন সব পানির উৎস শুকিয়ে গেছে। কোথাও চলতে চলতে ঝিড়ির শেষ মাথায় গর্তে অল্প পানি জমা আছে সেখান থেকেই বিভিন্ন পাড়ার ম্রো নারীরা পানি সংগ্রহ করছেন।
জেলা শহর থেকে ১২কিলোমিটার দুরে ম্রোলং পাড়া, সেই পাড়ার বাসিন্দা বিজিসি ট্রাস্ট মেডিকেল কলেজের নার্সিং ছাত্রী চামলে ম্রো বলেন কাকড়া ঝিড়ি থেকে পানি আনতে আসা যাওয়া দেড়ঘন্টা সময় লাগে।
ভোর চারটায় পানি আনতে গিয়ে সকাল ছয়টার সময় পাড়ায় ফিরে আসা যায় দুয়েক মগ পানি নেওয়ার পর আট মিনিট থেকে দশ মিনিট পানির জন্য অপেক্ষা করতে হয়। বয়স্ক নারীরা রাত দুটা তিনটার সময় পানি আনতে যায়। এক সাথে সবাই গেলে পানি পাওয়া যায় না তাই প্রতিবার দুই জন করে পানি আনতে যেতে হয়। এই ঝিড়ির পানি শুকিয়ে গেলে আরো দুরে একটি ঝিরি আছে সেখানে কাকড়ার গর্ত খুড়ে খুড়ে পানি সংগ্রহ করতে হয়।
ম্রো লং পাড়ার আরেক বাসিন্দা ৬০ বছরের ম্রো নারী হাই প্লেম ম্রো বলেন শুষ্ক মৌসুমের সময় পাড়ার নারীদের অন্যান্য কাজ বাদ দিয়ে শুধু নিরাপদ পানি সংগ্রহ করতেই অধিকাংশ সময় ব্যয় করতে হয়। বর্তমানে ২৬পরিবারের ম্রোলং পাড়ায় প্রতিবছর জানুয়ারী থেকে মে মাস পর্যন্ত অর্থাৎ বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত পাড়ায় পানি তীব্র সংকট থাকে। পাড়ার নারীদের পরিবারের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় পানির জন্য খুব কষ্ট করতে হয়। ভোরে একবার তুলেছিলেন আবার ১০টায় আরো একবার পানি আনতে ঝিড়িতে যাচ্ছেন, হাই প্লেম ম্রো জানান তিন ঘন্টা অপেক্ষা করার পর অল্প পানি পেয়েছেন।
রাংকোইসা ম্রো (৭১) বলেন পানির অভাবে দুই থেকে তিন মাস পর্যন্ত নিয়মিত গোসল করা যায়না। আরো অনেক দুরে যেতে হয়। যারা কাজে যায় যে যেখানে পানি পায় সেখানে গোসল করে বাড়ীতে ফিরে বলে জানান তিনি। আর নারীরা জুমের কাজে যাওয়ার সময় ময়লা কাপড় থাকলে সাথে করে নিয়ে যায়, যেখানে সামান্য পানি পায় সেখানেই কাপড় ধূয়ে থাকে এইভাবে চলে শুস্কমৌসুমে ম্রো পারাবাসীর জীবন। তিনি আরো বলেন এই অবস্থা চলতে থাকলে পানির সংকটের কারনে এখান থেকে অন্যত্র চলে যেতে হবে।
রেনিক্ষ্যং বাগান পাড়া ৩৮ ম্রো পরিবারের একমাত্র পানির উৎস বিউসনা ঝিড়ি। ঝিড়িতে তহ্জিংডং এনজিও থেকে জিফএস Gravety Flow System (GFS) দিয়ে পাড়ায় পানি সরবরাহ করা হয়েছে। কিন্তু মার্চ -এপ্রিল -মে মাসে ঝিড়ির পানি শুকিয়ে যাওয়ার কারনে পাড়ায় তীব্র পানি সংকট থাকে বলে জানান কনইয়াং ম্রো।
ক্রামাদি পাড়ায় ৪৪ পরিবারের ম্লাওঅ ঝিড়ি ও কাওতেওঅ ঝিড়ি দুইটা ঝিড়ির পানির উপর নির্ভরশীল। সিওঅ ঝিড়িতে মাধ্যাকর্ষণ প্রবাহ সিস্টেম Gravety Flow System (GFS) পদ্ধতিতে ৮হাজার ফুট পাইপ দিয়ে পানি পাওয়ার জন্য জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। তিনি আরো জানান পাড়ার নারীরা কে কখন ঝিড়িতে গিয়েছিল সময় টা জেনে কখন গেলে পানি পাওয়া যাবে সেই অনুযায়ী ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে রাখে, রাত বারটা -রাত দুটা।
পাকু ম্রো বলেন ইট ভাটায় লাকড়ি দেওয়া, অবৈধ কাঠ ব্যবসায়ীদের কারনে গাছ বাঁশ বনাঞ্চল সব উজার করা হয়েছে,ঝিড়ি ঝর্ণাগুলো থেকে অবাদে পাথর উত্তোলন করার কারনে আবহাওয়া পরিবর্তন হওয়াতে সময় মতো বৃষ্টি না হওয়ায় পানির সংকট তৈরী হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
ক্রামাদি পাড়ার তুমপিয় ম্রো জানান কেউ একবার পানি আনার পর তিন ঘন্টা পরে আরেকজন পানি পায়, সেজন্য ঝিড়ির কুয়াতে আসার আগে পাড়াতে জিজ্ঞাসা করতে হয় কুয়াতে কেউ গেছে কিনা কিংবা কে কতক্ষনে পানি আনতে গিয়েছিলেন, জিজ্ঞাসা না করে ঝিরিতে গেলে দুই থেকে তিন ঘন্টা অপেক্ষা করার পর বিশ লিটার পানি পাওয়া যায়।
ম্রো জনগোষ্ঠীর বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক ইয়াং ঙান ম্রো বলেন বনাঞ্চল ধংস, ঝিড়ির পাথর উত্তোলন করে পানির উৎস ধংস করার কারনে প্রতিবছর চিম্বুক এলাকার প্রায় ৯০টি পাড়ার ম্রো সম্প্রদায় বিশুদ্ধ পানির সংকটে থাকেন। দুর্গম এলাকার অন্যান্য সকল সম্প্রদায়ের বসবাসকারীরাও পানির সংকটে থাকে। সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা না থাকার কারনে প্রতিবছর জানুয়ারী থেকে মে মাস পর্যন্ত চিম্বুক এলাকা সহ দুর্গম আদিবাসী পাড়াগুলো বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকটে থাকে বলে জানান তিনি। তিনি শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন এভাবে চলতে থাকলে আগামী পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্য শুধু পানির অভাবে ম্রো জনগোষ্ঠী চিম্বুক -নীলগিরি এলাকা থেকে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হবে বলে জানান তিনি।
বান্দরবান সিভিল সার্জন ডা.নিহার রঞ্জন নন্দী বলেন দুর্গম এলাকায় মূলত বিশুদ্ধ পানির সংকটের কারনে এ অবস্থা হয়েছে। চিম্বুক-নীলগিরি এলাকার পাশে ও পাদদেশে বসবাসকারী ম্রো জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্যবিভাগ থেকে পানি বিশুদ্ধকরন ট্যাবলেট প্রেরণ করা হবে। এই শুষ্ক মৌসুমে পানি ফুটিয়ে পান করার পরামর্শ দেন তিনি। সর্বোপরি এলাকায় বিশুদ্ধ পানি ব্যবস্থা করতে হবেও বলে জানান।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী মোঃ খোরশেদ আলম বলেন দুর্গম এলাকায় পাথরের কারনে টিউবওয়েল স্থাপন করা যায়না, সেখানে রিংওয়েল এবং যে সকল ঝিড়িতে শুষ্ক মৌসুমেও পানি থাকে সেখানে বরাদ্ধ সাপেক্ষে জিএফএস পদ্ধতিতে পানি সরবরাহ করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। চিম্বুক এলাকায়ও ম্রো সহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য নিরাপদ পানির ব্যবস্থা কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলে জানান তিনি।
আরো পড়ুন-
আপনার মতামত লিখুন :