১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলার পথ পরিক্রমায় জঙ্গিবাদের উত্থান


জয় বাংলা নিউজ প্রকাশের সময় : ১৭/০৮/২০২১, ১:৩২ AM / ১৬৩
১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলার পথ পরিক্রমায় জঙ্গিবাদের উত্থান

১৭ আগস্ট বাংঙ্গালী জাতীয় জীবনে এক কাল অধ্যায়। রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক ভাবে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন ‘জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ’ (জেএমবি) কর্তৃক দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার ১৭ টি বছর অতিক্রান্ত হলো। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৫ সালের এই দিনেই সংগঠিত হয়েছিল নিঃসংশ বর্বচিত এই ঘটনা। জেএমবি বাংলাদেশের শুধু ১ টি জেলা বাদ দিয়ে বাকি ৬৩ টি জেলায় সিরিজ বোমা হামলা চালিয়েছিল এই কালো দিনে। অবিশাস্য হলেও সত্যি সাংগঠনিক ভাবে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনটির দেশব্যাপি এই বর্বচিত হামলা সংগঠিত করার জন্য এক হাজার ২০০ কোটি টাকার ফান্ড গঠন করা হয়েছিল।সংগঠণের আর্থিক ভাবে শক্তিশালি হওয়ার পেছনে হাত ছিলো মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ এবং বাংলাদেশের মাঝে স্বাধীনতা বিরোধি অপশক্তির। এই পক্রিয়ায় যার বেশির ভাগ টাকা যোগান দিয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের গঠিত একটি রাজনৈতিক দল, নামে বেনামে বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে জোগান দেওয়া হয়েছিল এই অবৈধ অর্থের।

২০০১ সালের আগেই বিএনপি-জামায়াতের প্রত্যক্ষ মদদে বাংলাদেশের মত একটি স্বাধীন স্বার্বভৌম রাস্ট্রে গড়ে উঠেছিল ধর্মীয় উগ্রবাদি এই সংগঠন গুলোর। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের পরিকল্পিত এই গ্রেনেড হামলা ছিল দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে শেখ হাসিনাকে হত্যার এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের ভয়ংকর দৃষ্টান্ত। আমরা পেছনে ফিরলে দেখতে পাই বোমা হামলার ভয়ংকর ঘটনাগুলো শুরু হয়েছিল তারও আগে থেকে। ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশোরের টাউন হল মাঠে উদীচীর সমাবেশে এক বোমা হামলায় নিহত হন ১০ জন সাধারণ মানুষ। একই বছরে ৮ অক্টোবর খুলনার নিরালা এলাকায় অবস্থিত কাদিয়ানিদের উপাসনালয়ে বোমা বিস্ফোরণে আটজন নিহত হন। ২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে সিপিবির মহাসমাবেশে বোমা হামলায় ছয়জন নিহত ও অর্ধশতাধিক আহত হন।

১৪ এপ্রিল রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসবে সংঘটিত বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন ১১ জন। ৩ জুন বোমা হামলায় গোপালগঞ্জের বানিয়ারচর গির্জায় নিহত হন ১০ জন, আহত হন ১৫ জন। সিলেটে একাধিক বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া নিহত হন গ্রেনেড হামলায়। ২০০৪ সালের ২১ মে হজরত শাহজালাল (রহ.) মাজার পরিদর্শনে গেলে গ্রেনেড হামলায় আহত হন তৎকালীন ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত আনোয়ার হোসেন।

এ ছাড়া আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সমাবেশে, অফিসে, নেতার গাড়িতে, সিনেমা হলে একাধিক বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে। উল্লেখ্য, ১৯৯৯ থেকে ২০০৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে বোমা ও গ্রেনেড হামলায় নিহত হয়েছেন শতাধিক বাংলাদেশি।রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ২০০১ সালে ক্ষমতায় আশে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার।ক্ষমতায় এসে রাজনৈতিক এই দলগুলো জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদী এ ধরনের তৎপরতা বন্ধে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। জঙ্গিবাদ দমনে তৎকালীন সরকারের নিষ্ক্রীয়তা দেশের মাটিতে জঙ্গিবাদ উত্থানে সহায়ক হয়ে উঠেছিল।

২০০৫র আগস্ট মাসের ১৭ তারিখে বাংলাদেশের ৬৩ জেলায় একযোগে পাঁচ শতাধিক বোমা বিস্ফোরণে, নিহত মানুষের স্বজনদের আর্তনাদ,আহাজারী ও আহত মানুষের কান্নায় আমাদের মনে ক্ষোভ ও ঘৃণা আরো তীব্র হয়ে উঠেছিল। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলায় খালেদা-নিজামী সরকারের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা ছিলো তা বর্তমানে আরো স্পষ্ট। অথচ সে সময় গণমাধ্যমের তরফ থেকে সর্বহারা নিধনের নামে দেশে ভয়াবহ জঙ্গিবাদের উত্থান হচ্ছে বলে বলা হয়েছে। সেই জঙ্গিবাদের শীর্ষ নেতা জেএমবির বাংলা ভাই বলেও জানানো হয়েছে। খালেদা-নিজামী সরকারের তরফ থেকে বাংলা ভাই মিডিয়ার সৃষ্টি বলে অভিযোগ করা হয়েছিল।

শেষ পর্যন্ত ২০০৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার জেএমবিকে রাজনৈতিক নিষিদ্ধ করে।রাজনৈতিক পথপরিক্রমার প্রথম দিকে বিএনপি-জামায়াতের প্রত্যক্ষ মদদে সংগঠিত হয়ে ওঠা জেএমবি সংগঠনটি সারা দেশে তাদের অস্তিত্ব জানান দিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জ জেলা বাদে দেশের ৬৩ জেলায় সকাল ১১টায় সিরিজ বোমা হামলা চালায় এই নিষিদ্ধ সংগঠনটি। দেশের ৩০০ স্থানে মাত্র আধা ঘণ্টার ব্যবধানে একযোগে ৫০০ বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে দুজন নিহত ও দুই শতাধিক লোক আহত হয়। হামলা চালানো হয় হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট, জেলা আদালত, বিমানবন্দর, বাংলাদেশে থাকা মার্কিন দূতাবাস, জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়, প্রেস ক্লাব ও সরকারি-আধাসরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা লক্ষ্য করে। হামলার স্থানগুলোতে জেএমবির লিফলেট পাওয়া যায়। লিফলেটগুলোতে বাংলাদেশে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করার বিষয়ে বক্তব্য লেখা ছিল। তাতে লেখা ছিল, দেশের কর্মরত বিচারকদের প্রতি একটি বিশেষ বার্তা পাঠালাম। দ্রুত দেশে ইসলামী হুকুমত কায়েম করতে হবে। নতুবা কঠিন পথ বেছে নিতে বাধ্য হবে জেএমবি। ইসলামী হুকুমত কায়েমের বিষয়ে তাদের সঙ্গে দেশ-বিদেশের অনেক শক্তিশালী দেশ ও শীর্ষ রাজনৈতিক দল একমত পোষণ করেছে। অতএব যাঁরা বিচারক আছেন তাঁরা তাগুতি (মানবসৃষ্ট) আইন বাদ দিয়ে ইসলামী আইনে বিচার করবেন। নতুবা আরো ভয়াবহ বিপদ আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে। এ সর্তকবাণীর (সিরিজ বোমা হামলা) পর আমরা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করব। তারপর আবার হামলা শুরু হবে।

নিষিদ্ধ সংগঠনটির দেশব্যাপি এই সিরিজ বোমা হামলার পর সারা দেশের বিভিন্ন থানায় ১৬১টি মামলা হয়। জঙ্গিবাদে উস্কানী ও মদদ দেওয়ার অভিযোগে বিএনপি নেতা ও সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আমিনুল হক, সাবেক উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী আলমগীর কবির, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনু, সাবেক এমপি নাদিম মোস্তফা বিরুদ্ধেও মামলা হয়। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে জঙ্গিবাদে মদদ দেওয়ার অভিযোগে ব্যারিস্টার আমিনুল হকের ৩১ বছরের সাজা হয়েছিল।
১৭ আগস্টের হামলার পরেও থেমে থাকে নি জঙ্গীবাদ অপতৎপরতা এর কিছুদিন পর আবার শুরু হয় ধারাবাহিক হামলা। ২০০৫ সালের ৩ অক্টোবর চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর ও চট্টগ্রামের জেলা আদালতে বিচারকার্জ চলাকালে একযোগে বোমা হামলা চালায় জেএমবি। এজলাসে ঢুকে বিচারককে লক্ষ্য করে বোমা ছুড়ে মারা হয়। ওই বছরের ১৯ অক্টোবর সিলেটের দ্রুত বিচার আদালতের বিচারক বিপ্লব গোস্বামীকে হত্যা করতে বোমা হামলা চালায় জঙ্গিরা। একই বছরের ১৫ নভেম্বর ঝালকাঠি শহরের অফিসার্স পাড়ায় জাজেস কোয়ার্টারের সামনে বিচারকদের বহনকারী মাইক্রোবাসেজেএমবি শক্তিশালী বোমা হামলা কওে হত্যা করে ঝালকাঠি জর্জ আদালতের সিনিয়র সহকারী জজ সোহেল আহমেদ চৌধুরী ও জগন্নাথ পাঁড়েকে।
এখানেই থেমে থাকে নি তাদেও এই তৎপরতা একই বছরের ৩০ নভেম্বর গাজীপুর ও চট্টগ্রাম আদালতে পৌনে এক ঘণ্টার ব্যবধানে আত্মঘাতী জেএমবি সদস্যরা গায়ে বোমা বেঁধে হামলা চালায়। এতে দুই জঙ্গি সদস্যসহ ৯ জন নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়। ওই বছরের ২ ডিসেম্বর গাজীপুর জেলা আদালতে চায়ের ফ্লাস্কে করে বোমা হামলা করে সাতজনকে হত্যা ও অর্ধশত ব্যক্তিকে আহত করে জেএমবি। দেশের রাজনৈতিক পরিক্রমায় সরকার বদলের ফলে সিরিজ বোমা হামলার আসামিরা ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুললেও তাদের অনুসারী ও মদদদাতারা এখনো সক্রিয় রয়ে গেছে।

২০১৬ সালের হলি আটিজনের হত্যাযজ্ঞ তার অন্যতম নজির। শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ব্যাপক ধরপাকড়ের মধ্যেও থেমে নেই উগ্রপন্থীদের সাংগঠনিক কার্যক্রম,তারা গোপনে নতুন সদস্য সংগ্রহ ও উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি চালাচ্ছে। সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২৯ মার্চ ২০০৭ সালে যে শীর্ষ জঙ্গিদের ফাঁসি কার্যকর করে তাদের সবারই জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। শায়খ আব্দুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই অতীতে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। ১৫ জুন ২০০৭ সালে দৈনিক পত্রিকা থেকে জানা যায়, গ্রেপ্তারকৃত কয়েকজন জেএমবি সদস্য অতীতে জামায়াতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেছে। তা ছাড়া আল-কায়েদা, লস্কর-ই-তৈয়বা, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ফ্রন্টসহ পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের সম্পর্ক বহুদিনের।

সাম্প্রদায়িক মনোভাব,ধর্মান্ধ,ধর্মের নামে উস্কানী মূলক দৃষ্টিভঙ্গির চূড়ান্ত পরিণতির নাম জঙ্গিবাদ।এখনি সময় এসেছে দেশ চিরতরে ১৭ আগস্টের মতো অপরাজনৈতিক তৎপরতা দূর করতে হবে। এ দেশের জঙ্গিবাদের শীর্ষ নেতা ও ধর্মীয় উগ্রবাদিতার পৃষ্ঠপোষকরা পাকিস্তান বা মধ্যপ্রাচ্যের দেশ গুলোতে গা ডাকা দিয়েছে। এখনি সময় তাদের সবাইকে চিহ্নিত করে কার্যকর ব্যাবস্থা গ্রহন করার।বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের অঙ্গিকার বাস্তবায়নে সপ্নের সোনার বাংলা গড়তে অবিলম্বে স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি,ধর্মীয় উগ্রবাদীদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখমুখি করতে হবে।তাদের বিচারের জন্য গঠন করতে হবে বিশেষ ট্রাইবুনাল। দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে বিচার ও রায় কার্যক্রম তাহলেই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জঙ্গিবাদের এই কালো গ্রাস থেকে মুক্তি পাবে।

মোঃ কাউছার সোহাগ
(সভাপতি) বাংলাদেশ ছাত্রলীগ,বান্দরবান পার্বত্য জেলা।